শীতকালিন সাকসবজির গুনগতমান পরিবর্ত!








সানাউল হক : 


শীতকালীন কাঁচা খাদ্যপণ্য তথা শাক সবজি ও অন্যান্য নিরামিষ জাতীয় খাদ্য দ্রব্যাদির পুষ্টিগত মান দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। কয়েক বছর পূর্বেও যেখানে সাধারণ কৃষকরা নিজেদের অধীনে বীজ বপনের মাধ্যমে শুধুমাত্র জৈব সার ও পরিমিত মাত্রায় রাসায়নিক দ্রব্যাদি প্রয়োগ করে শাকসবজি ও নিরামিষ জাতীয় খাদ্য উৎপাদন করত, সেখানে বর্তমানে বিশেষ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহৃত হওয়ার পর থেকেই তারা ভুলে গেছে স্বকীয়তা।


সমগ্র বাংলাদেশের ন্যায় ফরিদগঞ্জ উপজেলাতেও বহু বছর ধরে মৌসুমী শাকসবজি উৎপাদিত হয়ে আসছে। উপজেলার হাঁসা, হরিণা, প্রত্যাশী, সোভান, সাহাপুর, দক্ষিণ গোবিন্দপুর, দায়চারা, খাজুরিয়া, পাইকপাড়া, বাশারা, সাছনমেঘ, আস্টাসহ আরো বহু স্থানে অঞ্চলভিত্তিক এ জাতীয় শাকসবজি উৎপাদিত হয়। কিন্তু উৎপাদিত এ সকল কাঁচা পণ্য পূর্বের তুলনায় স্বাদ এবং পুষ্টির দিক দিয়ে তাদের যথাযথ মান বজায় রাখতে পারছে না। এতদ্সত্ত্বেও জনসাধারণকে একান্ত বাধ্য হয়েই সেগুলো ক্রয় করে নিতে হয়। হাটে-বাজারে ও কৃষকদের ছায়াতলে যে দিকেই নজর দেয়া যাক না কেন, সর্বত্র এ পুষ্টি জাতীয় খাদ্য পণ্যগুলোর একই নাম হাইব্রিড।


বিগত কয়েক বছর পূর্বেও উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় কৃষকরা উৎপাদিত ফসল থেকে কিছু অংশ বীজ বপনের জন্য রেখে দিত। নির্ধারিত সময়ে বীজ বপনের মাধ্যমে চারা উৎপাদনপূর্বক রোপণ করে পুনরায় ফসল উৎপাদন করে নিজেদের ঘরে তুলতো। দিনদিন হারিয়ে যেতে চলছে দেশীয় কৃষকের হাতের ছোঁয়া লাগানো সেই পুরানো দিনের সোনালি, লাল, নীল, সবুজ রঙ্গের শাকসবজিসহ অন্যান্য কাঁচা খাদ্য দ্রব্যাদি।


সাধারণত গ্রামাঞ্চলে নিত্যপ্রয়োজনীয় শাকসবজির মধ্যে আলু, মিষ্টি কুমড়া, লাউসহ আরো অনেক সবজি বছরের প্রায় সব সময়ে পাওয়া যায়। আর শীতকালীন সময়ে মৌসুমভিত্তিক ফলন শসা, খিরা, টমেটো, গাজর, শালগম, লাল শাক, শিম, বাঁধা কপি, ফুল কপিসহ আরো অনেক ধরনের শাকসবজি ও কাঁচা তরকারি জন্মে থাকে।


ফরিদগঞ্জের প্রায় সর্বত্রই শীতকালে কাঁচা তরকারির উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। শীতকালীন আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ জাতীয় কাঁচা পণ্যগুলো এ সময়েই ভালো জন্মে থাকে। তবে পূর্বের তুলনায় এ কালে যা উৎপাদিত হয়, তা শুধু মাত্র দেখতেই সুন্দর। কারণ, বর্তমান নানা বিষাক্ত রাসায়নিক সারের স্পর্শে উৎপাদিত বেশির ভাগ কাঁচা দ্রব্যাদির দেহ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে ও ভোগ-ভক্ষণের স্বাদে ভোক্তা এক প্রকার ভুলেই যায় রোগ বালাই'র কথা।



পূর্বে হাইব্রিড জাতীয় নানা ধরনের বীজ বাজারে পরিচিত না হওয়ায় কৃষকদের ফসলাদি উৎপাদন কোনো কোনো ক্ষেত্রে আশানুরূপ হত না। সাম্প্রতিককালে হাইব্রিডের বীজ ব্যবহার করে উৎপাদন ক্ষমতা বহু গুণ বৃদ্ধি হলেও দেখা দিচ্ছে তাদের মাঝে বিদ্যমান স্বাদ ও গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন।


হাইব্রিড জাতীয় শাক-সবজি চাষাবাদকারীরা সাময়িকভাবে নিজেদের লাভবান করতে গিয়ে প্রকারান্তরে ভোক্তাদের দেহকে রোগাক্রান্ত করে তুলছে। উদ্দেশ্য শুধু একটাই যে, নিরামিষ জাতীয় কাঁচা পণ্যগুলোকে যে কোনো রূপে বিক্রির উপযুক্ত করে হাট বাজারে তোলা। পূর্বে এ পণ্যগুলো আকারে ছোটখাটো হতো, তবে গুণগত মানে ছিলো দেহের পুষ্টি জাগানিয়া। এ জাতীয় শাকসবজি যেমন ছিলো স্বাদের, আর তেমনি ছিলো লোভনীয়। কিন্তু সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এক শ্রেণীর অনিষ্টকারীরা নতুনত্বকে আবির্ভাব করতে গিয়ে মানব দেহের ক্ষতি সাধন বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।


শাকসবজিতে বিদ্যমান পুষ্টিমান পৃথিবী জুড়েই মানব জাতির আনুকূল্য পেয়ে এসেছে। খাদ্য তালিকায় পুষ্টিগত মান নির্ণয়ে শীর্ষস্থান অক্ষুণ্ন রেখেছে খাদ্যপ্রাণ নামক শাকসবজি। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ভিটামিন জাতীয় এ জাতীয় খাদ্যপণ্য বহু বছর পূর্ব থেকেই উপদেশের বাণী বহন করে আসছে।



পূর্বে জনশ্রুতি ছিল, ধনী গরীবের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করা হতো আমিষ আর নিরামিষ জাতীয় তরকারির মধ্য দিয়ে। তবে ইদানীংকালে এসে এ ধরনের কাঁচা তরকারিগুলো স্বাদ আর বিস্বাদ পার্থক্যকে দূরীভূত করে আমজনতার নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য তালিকায় রয়েছে। এই সুবাদে মানব দেহের অতি প্রয়েজনীয় ভোগ সামগ্রী তথা শাক সবজি জাতীয় তরকারির উপর অনিষ্টকারীদের কুনজর পড়েছে।


উপজেলার ৯নং ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের চাষী মোঃ শাহ আলম জানান, পূর্বে শাকসবজি জাতীয় ফসল করেছি শুধুমাত্র নিজেদের শারীরিক পরিশ্রমের বিনিময়ে। মাঝে মধ্যে ফসলাদির উপর নির্ভর করে সামান্য কিছু অর্থে রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়েছে। আর বর্তমান সময়ে নানান রকমের রাসায়নিক দ্রব্যাদি ও কীটনাশকের দাম আমাদের মত ছোট খাটো চাষীদের অনেক ক্ষেত্রে নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে না দিতে পারায় অন্যদের মত তেমন ভালো ফসল ঘরে তুলতে পারি না।


গোবিন্দপুরের আব্দুর রাজ্জাক, মফিজুলসহ আরোও কয়েকজন জানান, বিগত কয়েক বছর পূর্বে চাষীরা এ অঞ্চলে হরেক রকমের শাকসবজি, মিষ্টি কুমড়া, বাঁধা কপি, ফুল কপি, দু-তিন ধরনের আলুসহ অন্যান্য ফসল কম খরচে ঘরে তুলতে পারতো। জায়গা ছিল বিস্তৃত, ছিলো উঁচু সমতল ভূমি, ছিলনা তেমন রাসায়নিক দ্রব্যাদির পরিচিতি। কম খরচে মোটামুটি মৌসুমভিত্তিক ফসল তুলতে পেরেছে। কিন্তু বীজ, সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য কৃষি সংশ্লিষ্ট যন্ত্রের দাম অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মত গরিবের নাগালের বাইরে থাকায় অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।


ফরিদগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুব-উর-রহমান জানান, মাটি থেকে গুণগত মানসম্পন্ন ফসল পেতে হলে সবার প্রথমে জৈব সারের ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি রাসায়নিক জাতীয় বিভিন্ন ধরনের সার এবং ফসলের ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে বিষ ব্যবহার করতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রে জৈব ও রাসয়নিক সার দুটিরই প্রয়োজন রয়েছে। তবে, প্রয়োজনের তুলনায় অধিক মাত্রায় এ সব প্রয়োগে গাছের ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি থাকে।


তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকার কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের চেয়ে জৈব সারের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করে আসছেন। জৈব সার তথা গোবর, কেঁচো, সবুজ উদ্ভিদ পচাসহ আরো অন্যান্য দ্রব্যের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের বিকল্প ও বিষ উৎপাদন করা সম্ভব। নিজেদের তৈরি এ জাতীয় দ্রব্যাদি ফসলে ব্যবহার করলে ফসলের মান আরো বেশি সমৃদ্ধ হবে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গির আলম শিপন এ প্রতিনিধিকে বলেন, পুষ্টি জাতীয় শাক সবজি উৎপাদন করতে রাসায়নিক দ্রব্যাদির চেয়ে জৈব সারকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। রাসায়নিক জাতীয় দ্রব্যাদি দ্বারা উৎপাদিত ফসলাদি মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর। তা সত্ত্বেও সঠিক পরিমাপে ব্যবহার করতে হবে।


নবীনতর পূর্বতন