পুড়ে যাচ্ছে দেশের টাকা, ক্ষয় হচ্ছে শরীল!


সানাউল হক :



বর্তমানে মাদকাসক্তি সমাজে এক সর্বনাশা ব্যাধিরূপে বিস্তার লাভ করেছে। কচুরীপানার মতই সারা দেশ আজ মাদকদ্রব্যের উপর ভাসছে। মাদকদ্রব্যের বিস্তারে বিশ^বাসী আজ শংকিত। দূরারোগ্য ব্যাধির মতই তা তরুন সমাজকে গ্রাস করছে। মাদকের ভয়াবহ ছোবলে অংকুেরই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে বহু তরুনের তাজা প্রাণ। আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে অসংখ্য তরুণের অমিত সম্ভাবনাময় জীবন। এর কারণে বিঘিœত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এর তীব্র দংশনে ছটফট করছে কত তরুণ ও যুব সমাজ।

মাদকের দুনিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য এখন এমন এক ধরনের লাল বড়ি ইয়াবা। যা মেথাএম্পিটামিন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি নেশা জাতীয় ট্যাবলেট। পয়েল পেপারে পুড়িয়ে বা বড়ি হিসেবে সেবন করা হয় এ মরন ব্যাধি নেশা জাতীয় ট্যাবলেট। এক সময় থাইল্যান্ডে তুমুল জনপ্রিয় এ মাদকটি মিয়ানমার হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, প্রাইভেট কোম্পানীর কর্মচারী বিত্তশালী পরিবারের ছেলে-মেয়ে-বউ কে নেই ইয়াবা নেশার তালিকায়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়, ফরিদগঞ্জ সদর, গাজীপুর, চান্দ্রা, টোরা মুন্সিরহাট, পাটওয়ারী বাজার, খাজুরিয়া , রূপসা, গৃদকালিন্দিয়া, রামপুর, নয়াহাট, ধানুয়া, বাগড়াসহ প্রায় সব বাজারেই ক্রেতা-বিক্রেতারা বিপাকে আছেন এক বিশেষ ধরণের পোড়া টাকা নিয়ে। সে সব টাকা সাধারণ ক্রেতা থেকে আরম্ভ করে বির্ভিন্ন কোম্পানী প্রতিনিধি, যানবাহনের চালক এমনকি ব্যাংকও নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে। খোঁঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব পোড়া টাকা মাদক দ্রব্য ইয়াবাসেবীদের ব্যবহৃত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ফরিদগঞ্জের প্রায় সর্বত্র রিক্সাচালক থেকে শুরু করে সমাজের কতিপয় শীর্ষস্থানীয় কতিপয় কর্তা ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় ইয়াবা সহজলভ্য হয়ে পড়ায় বেড়েছে বিভিন্ন বয়সি ইয়াবাসেবীদের সংখ্যা। বর্তমানে সারা দেশের ন্যায় ফরিদগঞ্জ উপজেলাতে এ নেশাজাতীয় দ্রব্যটি সেবনকারীদের নিকট বিলাসিতার বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রতিযোগীতা করে চলছে এ পাগলা বড়ি ইয়াবার ধোঁয়া ও স্বাদ গ্রহণ।

সিএনজি অটো রিক্সাচালক হারুন বলেন, প্রায় প্রতিদিনই  যাত্রীদের কাছ থেকে পোড়া টাকা পেয়ে থাকি। এ নিয়ে তাদের সাথে আমাদের অনেক সময় বাকবিতন্ডা চলে। পরে একান্ত বাধ্য হয়ে সে টাকা গ্রহণ করতে হয়। শুনেছি, ইয়াবা সেবনকালে আগুনে পুড়ে যাওয়ায় টাকার এ হাল হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পূর্বে সিগারেটের প্যাকেটের ভিতরে থাকা চিকচিকে কাগজ ও চকলেটের খালি মোড়কের উপর ইয়াবা পুড়িয়ে নেশা করা হত। কিন্তু এখন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় পয়েল পেপার দিয়াসলাই ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ নতুন ২, ৫, ১০, থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংখ্যার নোট মুড়িয়ে সারা হচ্ছে নেশার কাজ।

লোকচক্ষুর অন্তরালে ইয়াবাসেবীরা ঝামেলা এড়াতে তাদের সাথে থাকা নতুন চকচকে বিভিন্ন মানের টাকা পেঁচিয়ে নলের মত করে ইয়াবার ধোঁয়া শ^াসের ভিতরে নেয়। হাতে থাকা ইয়াবা সেবনের পর যে নির্যাস থাকে সেটাকে পুনরায় আগুনে গলিয়ে সেবন করে। ফলে, শেষ মুহুর্তে গ্রহণ করা ইয়াবার ধোঁয়া নেয়ার সময়ই মূলতঃ মোড়ানো টাকার গায়ে আগুন লেগে টাকার অংশ বিশেষ পুড়ে যায়। তারপর সে টাকা বিভিন্ন হাত ঘুরে প্রবেশ করে বাজারে। আর সেগুলো নিয়েই বিপাকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

এমন ছেঁড়া-পোড়া টাকার নোট দেখে সাধারণ মানুষ অনেক সময় বিচলিত হয়ে পড়েন। তারা মনে করেন যে, দেশে মাদকসেবনকারীদের বিস্তৃতি কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে এ টাকাই তার প্রমান স্বরূপ। গোটা দুনিয়া অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে ধারাবাহিকতায় উন্নতির পথে ধাবিত হতে চলছে। যেখানে অন্যান্য দেশে টাকার মান-মর্যদা দিনাদিন পরিবর্তন হতে চলছে, সেখানে আমাদের দেশ টাকাকে ব্যবহার করছে নেশার পাত্র হিসেবে। ইয়াবা উৎপাদনকারী দেশ মিয়ানমার। অথচ তারা এই পাগলা বড়িকে তার জাতির কাছে নেশার দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়নি।

মাদকের ভয়াবহ পরিনতি দেখে আজ প্রশাসন বিচলিত। অভিভাবকরা আতংকিত। চিকিৎসকরা দিশেহারা। তরুন যুব শক্তিই দেশের প্রাণ ও মেরুদন্ড। নেশার ছোবলে সেই মেরুদন্ড আজ ভেঙ্গে পড়ছে। নেশার ছোবলে ধুকে ধুকে মরছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ। কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাদের রক্ত মাংস। ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। দাবানলের মতই ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন শহরে, শহরতলিতে, গ্রামে-গ্রামান্তারে।

‘মাদক’ এর অর্থ বুজায়, নেশা যাতীয় দ্রব্য। যা সেবনের ফলে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি লোপ করে, তাই হলো মাদকদ্রব্য। সর্বকালের শ্রেষ্ট মহা মানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেন, প্রত্যেক নেশা জাতীয় বস্তুই মদ, আর তা হারাম। অধিক সেবন করলে যা নেশার সৃষ্টি করে, তা কম সেবন করাও হারাম। তিনি আরোও বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা অভিশাপ বর্ষণ করেছেন, মদের উপর, মদ্যপায়ীর উপর, মদ্য পরিবেশনকারী ও ডিলারের উপর, তার উৎপাদন যারা করে তাদের উপর, তার বহণকারীর উপর, যার জন্য বহন করে নিয়ে যাওয়া হয় তার উপর।

মাদক এমন এক ধররেন পাপের উৎস। যা সেবনের মাধ্যমে মানুষের মন মগজে অপরাধ প্রবনতা সৃষ্টি হয়। ভাল কাজ করার প্রবনতা, আগ্রহ ও আকর্ষণ ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে। পাপ কর্মের প্রতি চুম্বকের মত আকর্ষন সৃষ্টি হয়। এই জন্য মাদকসেবীরা নানা ধরণের পাপ কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। চুরি-ডাকাতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা মারামারি, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবজি, নারী ধর্ষণ, অপহরণ, ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, জ¦ালাও পোড়াও, অগ্নি সংযোগ ও লুটতরাজসহ যাবতীয় সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মাদক দ্রব্যকে প্রধানত ঃ দু’ ভাগে ভাগ করেছেন। প্রকৃতিক মাদকদ্রব্য ও রাসায়নিক মাদক দ্রব্য। ভেষজ থেকে যে মাদক উৎপন্ন হয়, গাছ-গাছড়া ও ফলমূল, খেজুর গাছ থেকে তাড়ি, আঙ্গুর বা খেজুর গাছ থেকে নাবিজ অন্যান্য এ সবই মূলত প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য।

পরীক্ষাগারে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় যে মাদক দ্রব্য উৎপন্ন হয়, তাই রাসায়নিক মাদকদ্রব্য। রাসয়নিক মাদকদ্রব্যের আজ ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। অসাধু ঔষধ কোম্পানীগুলো ঔষধ তৈরীরর নামে মাদকদ্রব্য উৎপাদন করে চলছে। রাসায়নিক মাদকদ্রব্য বেশি নেশা সৃষ্টি করে থাকে। যা প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য থেকে মারাতœক ও ধ্বংসাতœক।
রাসায়নিক মাদকদ্রব্য হচ্ছে, ইয়াবা, হিরোইন, মরফিন, কোকেন, মারিজুয়ানা, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল ইত্যাদি। এ জাতীয় দ্রব্যগুলোর মাঝে বর্তমান সময়ে জন সাধারণের অতি পরিচিত হচ্ছে ইয়াবা।

মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়শি ও চিরুনী অভিযান এ সব যেন সমাজের মধ্যে খুবই পরিচিত একটা শব্দ। আর গনমাধ্যমে প্রচারাভিযানে কোন ধাপেই কমতি রাখে না। ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া থেকে শুরু করে প্রিন্ট মিডিয়ার অনুকূলে যে রকম ভাবে সম্ভব হচ্ছে সে ভাবেই তুলে ধরছেন সমাজে। এই প্রচারভিযানের একটাই প্রত্যাশা সমাজ থেকে চিরজীবনের জন্য ধুয়ে মুছে যাক এই মরণ ঘাতক ব্যাধি নেশা।newssociety

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এইচ এম মাহফুজুর রহমান এ প্রতিনিধিকে জানান, ইয়াবা সেবনের কারণে টাকা পোড়ার ব্যাপারে এ পর্যন্ত কোন অভিযোগ পাওয়া যায় নি। তারপরও এ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ফরিদগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ শাহ্ আলম বলেন, টাকা পুড়িয়ে ইয়াবা সেবনের কথা অজানা। তবে, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক ও মাদকসেবীদের রুখতে অভিযান অব্যাহত আছে।
নবীনতর পূর্বতন