ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় আত্মগোপনে বহু পরিবার!


সানাউল হক: 



ফরিদগঞ্জ উপজেলা জুড়ে বহু পরিবার রয়েছে, যাদের রান্নাঘরের চুলায় আগুন জ্বলে না। রাত পোহালেই হাজির হবেন কিস্তির টাকার জন্য। এনজিওর স্যার আসবেন এই চিন্তায় রান্নার প্রস্তুতি বিপন্ন। এ ঘাট-ও ঘাট দৌড়ানোর পর অবশেষে প্রস্তুত করলেন ১০ কিস্তির মধ্যে ৪র্থ কিস্তি। আরো বাকি ৬টি। ঋণের টাকার ৪র্থ ধাপ পরিশোধের জন্য দীর্ঘ ১ সপ্তাহ ধরে সাফিয়া বেগম সর্বাত্মক চেষ্টায় সফল হলেন। বাকি কিস্তির জন্যে কোথায় যাবেন, কিভাবে জোগাড় করবেন এই চিন্তায় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন সাফিয়া বেগম। জানা যায়, তার স্বামী মোঃ আসিফ বেবী ট্যাঙ্ িচালক ছিলেন। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে পুরাতন একটা সিএনজি স্কুটার ক্রয় করেন। সড়ক দুর্ঘটনা, যান্ত্রিক ত্রুটি তার এ বাহনটির যেন পিছুই ছাড়ছে না। একদিকে ঋণ দাতাদের চাপ, অন্যদিকে বাহনের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বর্তমানে তিনি ছন্নছাড়া।


সকিনা বেগম, তার স্বামী মোঃ সিরাজ দিনমজুরের কাজ করে কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন। অধিক প্রয়োজনের তাগিদে একান্ত বাধ্য হয়ে স্থানীয় শাখার একটি এনজিও থেকে স্বল্প পরিমাণে টাকা উত্তোলন করেন। ছেলে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, মেয়ে নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। পরিবারের খরচের সাথে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাখাতে ব্যয় করাটা দিন দিন অসহনীয় হয়ে পড়েছে। একদিকে ঋণের সুদ অন্য দিকে ঋণের মূলধন পরিশোধ করতে হয়। পূর্বের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গেলে পুনরায় কিস্তি তুলতে হয়। এভাবে করে ধীরে ধীরে ঋণের ওজন বৃদ্ধি হয়ে যায়। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় নিরূপায় হয়ে ছাড়তে হলো তার পিতৃকূল।


নাম জানাতে অনিচ্ছুক ফরিদগঞ্জ পৌরসভার এমন একটা পরিবার ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে রয়েছে। দীর্ঘ ১ যুগ ধরে প্রবাসে কাটানোর পরেও ওই পরিবার প্রধানের ভাগ্যের চাকা সচল হয়নি। বহু চেষ্টা করেও প্রবাস জীবন সুখময় হয়নি বলে ফিরে আসতে হয়েছে মাতৃকূলে। পারিবারিকভাবে দেয়া আর নিজেদের জমানো ক্ষুদ্র পুঁজির উপর নির্ভরশীল হয়ে চায়ের দোকান দিয়ে পরিবারের সুখের চাকা ঘোরাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। অবশেষে বাঁচার জন্য নিকটাত্মীয়ের সহযোগিতায় নিতে হয়েছে ঋণ। সুদের ভাগ দিতে না দিতেই মাথায় ভর করে থাকে ঋণের টাকা। সময়ের উপর নির্ভর করে সুদের টাকার অংকটা অধিক হারে বেড়ে যায়। সুদের টাকা পরিশোধ করতে গেলে ঋণের টাকা অবশিষ্টই রয়ে যায়। অবশেষে বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে রয়েছে পরিবারটি।


সাম্প্রতিককালে দেখা যায়, গরীব অসহায় জনসাধারণের সহযোগিতার নামে দেশের প্রতিটি স্থানে নামে বে-নামে বিভিন্ন এনজিও, সমিতি ও স্থানীয় সুদের কারবারিরা উচ্চ হারে অসহায় নাগরিকের মাঝে লোন বন্টন করে থাকে। এ সংস্থাগুলোর নিকট থেকে আর্থিক লোন দাবি করতে হলে চ্যালেঞ্জিং চুক্তিতে রাজি হতে হয়। যার মাঝে অন্যতম চুক্তি হচ্ছে বসত ভিটার দলিল, পরিবার অথবা পার্শ্ববর্তী কোনো আত্মীয়-স্বজনের জিম্মাদারিত্ব, আরো নানা শর্ত সাপেক্ষ। প্রয়োজনের তাগিদে আর্থিক লোনকারীরা এসব বাস্তুহারা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে আজ ঘর-সংসার ছেড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।


পৌর বাসিন্দা হুমায়ুন খান জানান, এমন অসংখ্য পরিবার রয়েছে যারা কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পারায় আজ বাস্তুহারা হয়ে আছে। স্থানীয় এনজিওগুলো শুধুমাত্র পরিচিত জিম্মাদার হলেই যাকে-তাকে ঋণ প্রদান করে থাকে। জিম্মাদার সনাক্ত হলে বাকি সব গ্রাহকের নিকট থেকে অকপটে নেয়া যায়। একবার লোন করা হয়ে গেলে তো আর পিছু ছাড় নেই। বাড়ি বাড়ি এমনও পরিস্থিতি দেখা যায়, ঋণের কিস্তির মেয়াদ ওভার হলেই সকাল থেকে রাত অবধি চলে তর্ক বিতর্ক আর হুমকিধমকি। জনসাধারণের ভাষ্যানুযায়ী, একজন ঋণ গ্রাহক একাধিক সংস্থা থেকে ঋণ উত্তোলন করে থাকে। যা পরবর্তীতে পরিশোধ করার কোনো পথ না থাকাতে আত্মগোপন হয়ে যায়। বারবার এমনটা হতো না যদি এনজিওগুলো একজন ব্যক্তিকে ঋণ দেয়ার প্রাক্কালে তার পূর্ব স্থান সম্পর্কে খোঁজ নিতো। একাধিক সংস্থা থেকে লোন উত্তোলন করা সত্ত্বেও পরিশোধ করেনি এমন ব্যক্তিকে কোন্ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে পুনরায় অন্য সংস্থা বা একই সংস্থা ঋণ প্রদান করে তা অনেকেরই বোধগম্য নয়।


হান্নান বাবুল পাটওয়ারী জানান, সীমিত সময়ের মধ্যে উচ্চহারে অসহায়দের মাঝে দেয়া লোন পরিশোধে ব্যর্থ হলেই চলে অমানবিক আচরণ। ঋণ গ্রহীতার সন্তান নিয়ে টানা-হেঁচড়া, ঘরের চাল-চুলার আসবাবপত্রাদি, আবার কারো ঘরের টিন, কারো বেলায় বসত-ভিটা দখলে নিয়ে নেয়া। সংসারে সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনতে ভিক্ষার আদলে পার্শ্ববর্তী নামি-দামি আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতায় এনজিওগুলোর নিকট থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা অথবা উদ্দেশ্যানুযায়ী কাজ করে থাকে। এনজিওগুলোর নিকট থেকে ঋণ গ্রহীতাদের নেয়া অর্থ উদ্দেশ্যানুযায়ী কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ব্যবহৃত হয় না। তখনি নেমে অসে এ ধরনের পরিবারে মানবিক বিপর্যয়। এ ঘাট-ওঘাট পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে ধরা দেয়।


মোঃ ওমর ফারুক আজাদ জানান, উপজেলাব্যাপী বহু সংখ্যক ঋণদাতা সংস্থা রয়েছে। অমানবিক নির্যাতনে দিন যায় রাত আসে, মাস যায় বছর ফুরিয়ে আসে, ফুরায় না চক্রবৃদ্ধি হারের সুদের অংকটা। উপজেলাব্যাপী এমনও ঋণ গ্রহণকারী রয়েছে যারা ক্ষুদ্র ঋণ তোলার পর এর কয়েক গুণ বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়। ঋণদাতারা ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের টাকা আদায়ের হিসেব করলে সুদের টাকায় ঋণ পরিশোধ হয়ে যায়। ঋণের অংকটা ঠিকই মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। একজন ঋণগ্রহীতা জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত ঋণদাতার মানসিক নির্যাতন থেকে রেহাই পায় না।


গত অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ। এটি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাব। এর আগে বিবিএসের সাময়িক হিসাবে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছিল। অন্যদিকে সাময়িক হিসাব থেকে ৮ ডলার বেড়ে দেশের মানুষের মাথা পিছু আয় এখন ১ হাজর ৬১০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নত রাষ্ট্রে পদার্পণ করায় এ খুশির সুবাদে সারা দেশব্যাপী আনন্দ উৎসব উদ্যাপিত হয়েছে। উপজেলার ঋণগ্রহীতা সদস্যরা জানান, যে ঋণের দায় মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়, গড় হিসেব করতে গেলে তার দুইগুণের বেশি পরিশোধ হয়ে যায় ঋণের সুদ প্রদানের মাধ্যমে। তবুও ঋণ রয়েছে দাঁড়িয়ে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কি আমাদের বেলায় নেই?


উপজেলা সমাজসেবা অফিসার ২৮ মে চাঁদপুরে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকাতে এ বিষয়ে তার সাথে আলাপ করা যায়নি।


উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী কর্মকর্তা এএইচএম মাহফুজুর রহমান বলেন, উপজেলাব্যাপী বহু সংখ্যক এনজিওর শাখা রয়েছে। এ ধরনের সংস্থাগুলো থেকে বিপদগ্রস্ত মানুষ ঋণ উত্তোলন করে থাকে। বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যায়, ঋণ উত্তোলনকারীদের মধ্যে অনেক লোক গা ঢাকা দিয়েছে। ঋণ দাতা সংস্থাদের স্মরণ রাখতে হবে যাকে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে তার দেয়ার সামর্থ্য আছে কিনা। কোনো রকম দালালের সহযোগিতায় ঋণ প্রদান করলে এ ক্ষেত্রে জটিলতা বাড়বেই। একজন গ্রাহক একাধিক সংস্থা থেকে ঋণ উত্তোলন করার পূর্বেই তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় খোঁজ নেয়া দরকার ঋণদাতা সংস্থার।

নবীনতর পূর্বতন