সানাউল হকঃ
চাঁদপুর জেলার সর্বমোট ৭টি পৌরসভার মধ্যে একটি হচ্ছে ফরিদগঞ্জ। ফরিদগঞ্জ পৌরসভা ২০০৫ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এ পৌরসভাটি চাঁদপুর জেলার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বিস্তৃত পৌরসভা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এর নিজস্ব কোনো ভবন নেই। ফরিদগঞ্জ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিত্যক্ত একটি ভবন তাদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী ১৯.৭৫ বর্গ কিঃ মিঃ বা ৭.৬৩ বর্গমাইল আয়তনের এ পৌরসভার মোট জনসংখ্যা ৩৪,৬১১। জেলার সকল পৌরসভার মাঝে একমাত্র নিম্নমানের তথা 'খ' শ্রেণির পৌরসভা হিসেবে রয়েছে শুধুই ফরিদগঞ্জ।
৫০ হাজারের কম জনসংখ্যা নিয়ে গড়ে ওঠা ফরিদগঞ্জ পৌরসভা সেবা প্রদানের দিকে তেমন একটা সুফল বয়ে আনতে পারেনি। তা সত্ত্বেও জনসাধারণ পৌরসভার বিভিন্ন খাতে নেয়া কর পরিশোধ করে আসছে। যদিও পৌরসভা প্রারম্ভকাল থেকে নামমাত্র পৌরকর মওকুফ করে দিয়েছেন বলে দাবি করছেন সাবেক মেয়র। পৌর মেয়র মাহফুজুল হক বলেন ভিন্ন কথা। পূর্বের মেয়র মঞ্জিল হোসেন পৌরট্যাঙ্ না তোলাতে ঋণগ্রস্ত হয়ে আছে এ পৌরসভাটি। পৌরবাসিন্দা জহির গাজী জানান, মেয়র মাহফুজুল হক দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কিছুটা হলেও জনদুর্ভোগ লাঘব হতে যাচ্ছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জনসাধারণের অতীতের লেগে থাকা বিভেদ মিটিয়ে দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বনিম্নমান তথা 'গ' শ্রেণির আওতায় ছিল এ পৌরসভা। বর্তমান মেয়রের ঘোষণা অনুযায়ী পৌরসভাটি এখন 'গ' শ্রেণি থেকে 'খ' শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। চাঁদপুর জেলার যে ক'টি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে এ উপজেলাতেই আছে বেশিরভাগ। এর মাঝে সবচেয়ে পরিচিত প্রাকৃতিক নিদর্শন ডাকাতিয়া নদী। আর সে নদীর তীর ঘেঁষেই অবস্থিত রয়েছে জেলার দ্বিতীয় বৃহৎ এ পৌরসভাটি। যে কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না যে এটাই সেই বিস্তৃত পৌরসভা।
ফরিদগঞ্জ বাজার কমিটির আহ্বায়ক অহিদুর রহমান জানান, পৌরসভা গঠনের দীর্ঘ ০৯ বছরেও এর নামকরণ আঞ্চলিক বাজারের নামেই থেকে গেল। হলো না পুরোপুরি শহুরে আবহ তৈরি। একটি পৌরসভাতে জনসাধারণের অতি প্রয়োজনীয় যা উপকরণ দরকার তার অধিকাংশই নেই। পৌরসভার প্রধান সড়কটি দীর্ঘদিন ধরে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছে। সংবাদকর্মীরা একাধিকবার সড়ক সংস্কার নিয়ে লেখালেখির পরে কিছু অংশ কাজ করে পুনরায় বন্ধ করে রেখেছে। এভাবে পৌর সড়ক জুড়ে আরো জনদুর্ভোগ বেড়েছে। তিনি আরো বলেছেন, পূর্বের মেয়রের সাথে স্থানীয় এমপির ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান না থাকাতে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বর্তমান এমপির সাথেও পৌর মেয়রের একই রকম সম্পর্ক। মাঝখানে সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা পৌরবাসী।
বায়োবৃদ্ধ আঃ হালিম বলেন, নামেমাত্র পৌরসভা, বিদ্যুৎ না থাকলে রাত হলেই অন্ধকার নেমে আসে। ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানে ঝুলানো ডিজিটাল সাইনবোর্ড আর পৌরসভার কিছু সংখ্যক লাইট থাকাতে বিদ্যুৎ থাকাকালীন মোটামুটি আলোকিত থাকে। বাজারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যে ক'টি সৌর বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেগুলো দিয়ে বাজার আলোকিত হয় না। পৌর শৌচাগার বলতে যা রয়েছে তা ব্যবহার করার মতো অবস্থায় নেই। বাজারের শেষ দিকে অবস্থিত কসাইখানার পেছনে রয়েছে শৌচাগারটি। নেই মান সম্মত ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পায়ঃনিষ্কাশনের জন্যে গত বছর বর্তমান মেয়র যে ক'টি স্থানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা করেছিলেন, তার কোনো কোনো স্থানে মেরামতে ত্রুটিজনিত কারণে বৃষ্টির পানি সঠিক পরিমাণে ড্রেনের ভেতর গড়ায় না। ফলে সামান্যতম বৃষ্টি হলেই কাদা পানিতে একাকার হয়ে যায়। তবে পৌর মেয়রের আদেশে সময় সময় ড্রেনের ময়লা পরিষ্কার করায় কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া যায়।
ফরিদগঞ্জ পৌরসভাতে সর্বমোট ওয়ার্ড ০৯টি। জরাজীর্ণ মূল শহরেই নেই বিশুদ্ধ পানির লাইনের ব্যবস্থা। গ্যাস লাইন নির্মাণ না হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী এ শহরজুড়ে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক শিল্প গড়ে উঠতে পারে নি। বর্তমান সরকারের শাসনামলে ফরিদগঞ্জে বিদ্যমান কয়েকটি সমস্যা দূরীকরণের জন্য চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ)-এর মাননীয় এমপি ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া বর্তমান জাতীয় সংসদের গত ১৭তম অধিবেশনে কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরেছেন। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এ উপজেলায় গ্যাস লাইন নির্মাণের প্রস্তাব। তবে গ্যাস ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এমপি তাঁর আনীত প্রস্তাব সরকারি নিয়মে গ্রহণ করা সম্ভব নয় বলে গৃহীত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের অনুরোধ জানান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের কোথাও আবাসিক এলাকাতে গ্যাস সংযোগ দেয়ার নিয়ম নেই। শুধুমাত্র বাণিজ্যিক এলাকা ছাড়া। তা সত্ত্বেও ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূঁইয়া জাতীয় সংসদে ফরিদগঞ্জে গ্যাস লাইন নির্মাণের জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখেন।
এ পৌরসভার প্রাণকেন্দ্রে সরকারি-বেসরকারি সর্বমোট ৭টি ব্যাংক রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী স্বনামধন্য ৩টি বড় মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আছে জনসাধারণের অতি প্রয়োজনীয় সরকারি-বেসরকারি সেবা প্রদানকারী সংস্থা। গত কয়েক বছর ধরে ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরে তথা পৌর এলাকায় একে একে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আগুন লেগে মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। একটি ফায়ার স্টেশনের অভাবে বিগত বছরগুলোতে বাজার ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকার সম্পদ আগুনে কেড়ে নিয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা কয়েক বছর যাবৎ ফায়ার স্টেশন নির্মাণের বিষয়ে লেখার পরেও ফল মিলেনি। এমনকি একটি ফায়ার স্টেশন নির্মাণের দাবিতে ফরিদগঞ্জবাসী কয়েকবার মানবন্ধন করেও কোনো ফল পায়নি।
জেলার দ্বিতীয় বৃহৎ এ পৌরসভাজুড়ে রয়েছে কিছু ভালো মানের প্রতিষ্ঠান। তার মাঝে অন্যতম নিদর্শন হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে কেরোয়া ওয়ার্ডে বেসরকারিভাবে নবনির্মিত প্রবীণ নিবাস। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে যে ক'টি স্থানে সবচেয়ে বেশি মৎস্য চাষ করা হয় তার মাঝে এ পৌরসভাও রয়েছে। এছাড়াও কৃষিপণ্য উৎপাদনের দিক দিয়ে রয়েছে কয়েক জাতের ধান, পাট, শাক-সবজি, নারিকেল, সুপারি, সরিষা, আখ ইত্যাদি। বিস্তৃত আয়তন, তুলনামূলক কম জনসংখ্যা, এমন নদী দ্বারা সমৃদ্ধ যাঁর নাম বিভিন্ন গল্প-কবিতায় জড়িয়ে আছে , এমন আরো অপরূপ নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও এ পৌরসভাটি কেন অবহেলিত হয়ে আছে সেটাই প্রশ্ন ফরিদগঞ্জের সচেতন মহলের।
ফরিদগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মাহ্ফুজুল হক জানান, ফরিদগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হওয়ার পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন বলতে তেমন কিছুই ছিল না। বর্তমানে আমার মাধ্যমে ফরিদগঞ্জ পৌরসভা ধীরে ধীরে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় উপনীত হতে চলছে। বিগত সময়ে পৌরসভার ভেতরে থাকা অধিকাংশ রাস্তাই পাকা নির্মাণ করে দিয়েছি। যেখানে সম্ভব হয়নি, সেখানে আস্তে করে এগিয়ে যাচ্ছি। সাবেক মেয়র নামমাত্র পৌরকর মওকুফ করে দিয়ে আসলেও বাস্তবে এসে দেখি তার পুরোটাই এ পৌরসভার অধীনে বাকি রয়ে আছে। পৌরবাসীর সুবিধার্থে আমি কর প্রদানে অনুরোধ করে থাকি। তিনি আরো জানান, শূন্য অবস্থায় হাতে পাওয়া এ প্রতিষ্ঠান থেকে যেভাবে সম্ভব হয়েছে পৌরবাসীর জন্যে করে যাচ্ছি। পৌর নাগরিকসেবা প্রদানে আমার অক্লান্ত পরিশ্রম অব্যাহত রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যমান পৌরবাসীর পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনীতিকেন্দ্রিক সমস্যা দূরীভূত করে যাচ্ছি।
ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভঁূইয়া এমপি বলেন, বর্তমান সরকার জনবান্ধব হয়ে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী ফরিদগঞ্জে বিগত আমলে তেমন কোনো উন্নয়নের ছাপ পড়েনি। শুধু অতি সম্প্রতিই নয়, বিগত ক'বছর যাবৎ জাতীয় সংসদে ফরিদগঞ্জের বিভিন্ন সমস্যা দূর করার জন্য জোর দাবি জানিয়ে আসছি। যতটুকু সম্ভব হয়েছে, উপজেলাবাসীর কথা বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে পেঁৗছাতে সক্ষম হয়েছি। উপজেলার সমগ্র ইউনিয়নের ন্যায় পৌরসভাটিও আমাদের সকলের। ফরিদগঞ্জ পৌরসভা যেহেতু বয়সের দিক দিয়ে তেমন একটা পুরাতন নয়, নতুন, সব কিছুরই পরিবর্তন হওয়াটা সময়ের ব্যাপার। তা সত্ত্বেও উপজেলা সদরের অতি প্রয়োজনীয় যে ক'টি সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে, তা লাঘবের চেষ্টা আমি অব্যাহত রেখেছি।
Tags
News