বেহাল সড়কে চলছে দূর্ঘটনা! বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।


সানাউল হক:

সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু একটি পরিবারের সারাজীবনের কান্না। বর্তমানে সড়ক দুর্ঘটনায় জীবনহানি যেনো নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ কর্তৃপক্ষ কার্যকর উদ্যোগ নিলে সড়ক দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর মিছিল রোধ করা সম্ভব। চালকদের বেপরোয়া গতি, অনভিজ্ঞ চালক, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন
ব্যবহার, উপজেলাব্যাপী সড়কগুলোতে কৃষি কাজে ব্যবহৃত কলের লাঙ্গল দানব ট্রাক্টরগুলোর আবাধ বিচরণ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ট্রাফিক ব্যবস্থার বেহাল দশা, খানাখন্দে ভরা সড়ক-মহাসড়ক, চলমান অবস্থায় অন্য যানের সাথে প্রতিযোগিতার প্রবণতা এবং পথচারীদের অজ্ঞতার কারণে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার দুর্ঘটনাকে অনিবার্য করে তুলছে।


দুই ধাপে ৫৮ কি. মি. সড়কে প্রায় ১শ' ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে খাজুরিয়া থেকে শুরু হয়ে হাজীগঞ্জ এবং ওয়্যারলেস বাজার থেকে চাঁদপুর-ফরিদগঞ্জ-রায়পুর সড়কের উন্নয়ন-সংস্কার কাজ হরদমে শুরু হয়ে গেছে। আগামী ১৯ জুনের মধ্যে এ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে বলে সূত্রে জানা যায়। এমতাবস্থায় সড়কের দুই পাশ বিস্তৃতি ও পুরো সড়কের চলমান কাজ নিয়ে চালক ও পথচারীদের মাঝে এক ধরনের অজানা সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ফরিদগঞ্জ উপজেলায় গুরুত্বপূর্ণ যে ক'টি সড়ক রয়েছে তার বেশির ভাগই চলাচলের অনুপযোগী। জেলায় প্রবেশের সড়কটিও দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত হয়ে পড়েছিলো। চলতি বছরে এ সড়কটির কাজ শুরু হয়েছে দেখে যাত্রী ও উপজেলাবাসীর চোখে একদিকে আনন্দ আর অন্যদিকে সংশয় লক্ষ্য করা যায়।


গত ২৮ এপ্রিল চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে ফরিদগঞ্জ ডায়াবেটিক হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকাতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় মামুন নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। অপর ২ জন গুরুতর আহত হয়ে আড়াইশ' শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছেন। জানা গেছে, ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-ড-১১-২৯১১)কে অপরদিক থেকে বেপরোয়া গতিতে বালীবাহী পিকআপ (ঢাকা মেট্রো-সন-১৩-৭৭৭২) ধাক্কা দিলে ট্রাকটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এছাড়াও ২০ মার্চ চাঁদপুর-রায়পুর সড়কের ধানুয়ায় বেপরোয়া গতির একটি বালুবাহী ট্রাক্টর গাছের সাথে ধাক্কায় চালক থেতলে যায়। এতে চালককে গাড়ির অংশ কেটে বের করতে হয়েছে। ১২ মার্চ ভাটিয়ালপুর মুন্সিবাড়ি সংলগ্ন এলাকায় ঢাকা মেট্রো-গ ১৪-৯৪৮২ নম্বরের একটি প্রাইভেটকারের সাথে অটোরিঙ্ার মুখোমুখি ধাক্কায় যাত্রীসহ অটোরিঙ্াটি জলাশয়ে পড়ে যায়। এভাবে দিনের বিভিন্ন সময়ে এ সড়কের বিভিন্ন স্থানে এমন অসংখ্য দুর্ঘটনার প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়। বিগত ২/৩ বছরে এ সকল দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অনেক। ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ৩ বছরে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে ২৪টি। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কত তা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারেনি ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ।


ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা হাবিবুর রহমানসহ আরো ক'জন জানান, চাঁদপুর-রায়পুর সড়কে বড় ধরনের যানবাহনের সাথে পাল্লা দিয়ে দৈনন্দিন চলাচল করে থাকে ৩ চাকার যাত্রীবাহী সিএনজি স্কুটার। যে বাহনটি সর্বসাকুল্য তিনজন যাত্রী নিয়ে চলাচল করার কথা, দেখা যায় ৬/৭ জন যাত্রী নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে গন্তব্যস্থলে। একদিকে লক্কড়-ঝক্কড় সড়ক, অন্যদিকে ক্ষুদ্র একটি বাহনে নিয়ম বহির্ভূত তিনের অধিক যাত্রী নিয়ে পাড়ি দেয়াটা জীবনের জন্যে এক প্রকার হুমকিস্বরূপ। তবে সিএনজি স্কুটারের মালিক, চালকরা বলেন অন্য কথা। গ্রামের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলে সিএনজি অটোরিঙ্া রিজার্ভ নেয়া হয় না। তিনজন যাত্রী নিয়ে ১৮/২০ কি. মি. পথ পাড়ি দিতে গেলে খরচের সাথে মিলে না। এছাড়াও দিন দিন জ্বালানিমূল্য ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালকরা বিভিন্ন কৌশলে বাহন চালাতে হচ্ছে।


ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজির শিক্ষার্থী মোঃ হামজা পাটওয়ারীসহ আরো ক'জন কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী জানান, চাঁদপুর-রায়পুর সড়কে জনদুর্ভোগের অন্ত নেই। খানাখন্দে ভরা সড়কজুড়ে একদিকে ধূলোবালির আক্রমণ, অন্যদিকে চালকদের বেপরোয়া চলাচলে বিঘ্নতা। ইতোমধ্যে সড়কের কাজ শুরু হওয়াতে ধূলোর প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিক, কিন্তু দিবানিশি চলাচলরত ট্রাক্টরগুলোতে খোলামেলা গুঁড়ি গুঁড়ি বালি বহনকালে দিনের বেলায় তা উড়ে যাত্রীদের দেহে-মুখে প্রবেশ করে। লক্কড়-ঝক্কড় সড়কের বুকের উপর দিয়ে চলাচলরত ফিটনেসবিহীন গাড়ির প্রবল ঝাঁকুনির কারণে সড়কের দুই পাশ জুড়ে বালি জমে থাকে। এ কারণে পথচারীদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়।


চাঁদপুর-রায়পুর সড়কের দৈনন্দিন যাত্রী চাকুরিজীবী মোঃ আমিনুল হক জানান, সড়ক দুর্ঘটনা প্রাকৃতিক নয়, মানবসৃষ্ট কারণ। সে সমীকরণে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতরা পরোক্ষভাবে হত্যারই শিকার হন। কিন্তু হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার জনকাঙ্ক্ষিত উদ্যোগ নেই বাংলাদেশে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা না কমে জ্যামিতিক হারেই বেড়ে চলছে। এমন কোনোদিন নেই, যেদিন সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে না, আর যেদিন সড়ক দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে না। বেহাল সড়কে বের হলেই দেখা যায় রক্তের বৃত্তের উপর পড়ে আছে অবহেলিত ভাবে নিথর দেহ। প্রতিদিনই সাধারণ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় রক্তাক্ত হচ্ছেন, ছিন্নভিন্ন লাশে পরিণত হচ্ছেন। দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো এখন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বড় মাপের কন্ট্রাক্টর জানান, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অধীন সড়কগুলোতে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কারণে দেশের সড়কগুলোর স্থায়িত্ব কমে যাচ্ছে। এছাড়াও সড়কে নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারের কারণে গরমের সময় তা গলতে শুরু করে। এ কারণে সড়কে গর্ত ও ফাটল দেখা দেয়। পেভমেন্টও উঠে যায়। এমনকি রাস্তা নির্মাণ শেষে সড়কের দুই কিনার জুড়ে থাকা লেভেল সঠিকভাবে মিলিয়ে না দেয়াতে নির্মাণের কিছুদিন পরেই ফাটল তৈরি হয়। সড়ক মহাসড়কে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার বন্ধ করতে হলে তদারকি বাড়ানোর বিকল্প নেই। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সঙ্গে মিলে ঠিকাদার এটি করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।


অভিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, যেসব ঠিকাদার নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করবেন তাদের কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে, যাতে আর কাজ করতে না পারে। অনেক সময় দেখা গেছে, সড়কের সংস্কার শেষ হতে না হতেইে সেটি ভেঙ্গে যাচ্ছে, কিন্তু ঠিকাদাররা ঠিকই তাদের অর্থ পেয়ে যাচ্ছেন। এটি বন্ধ করা জরুরি। সড়ক নির্মাণের পর সেটি সঠিকভাবে পরীক্ষা করিয়ে সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমেই ঠিকাদারদের অর্থ প্রদান করতে হবে। সওজ কঠোর হলে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার বন্ধ করা কঠিন ও অসম্ভব কোনো কাজ নয়। সদিচ্ছা ও দুর্নীতি না থাকলে এই ব্যবহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে মোটেই দেরি লাগবে না।


চাঁদপুর জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুব্রত দত্ত বলেন, সওজ সড়কের নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে জনসচেতনতার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থানজুড়ে বিভিন্ন সঙ্কেত প্রদান করে থাকে। যাতে করে চালক পথচারীরা দুর্ঘটনার শিকার না হতে হয়। চালক পথচারীরা তা মানা না মানার উপরেও অনেক ক্ষেত্রে এ সমস্যার অবনতি-উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া চাঁদপুর সওজ-এর মাধ্যমে আগামী কয়েকদিনে এক সাথে ৫শ'-এর অধিক গাড়িতে করে জনসচেতনতমূলক প্রচারাভিযান চালানো হবে। সারাদেশের ন্যায় চাঁদপুর জেলাব্যাপী সড়ক উন্নয়নের কাজ চলছে। চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়কের খাজুরিয়া থেকে শুরু করে হাজীগঞ্জ-ওয়্যারলেস এবং ফরিদগঞ্জের শেষ সীমানা বর্ডার বাজার পর্যন্ত দুই ধাপে একযোগে কাজ চলছে। সড়কের দুই পাশ বিস্তৃত এবং মূল সড়কের কাজ একই সাথে করা হচ্ছে।

নবীনতর পূর্বতন